অপরিচিতা গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন এবং উত্তর

অপরিচিতা গল্পের পরিচিতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা “অপরিচিতা” গল্পটি বাংলা সাহিত্যের একটি অনন্য সৃষ্টি। এটি মূলত সমাজের রূঢ় বাস্তবতা ও নারীর অবস্থানের ওপর আলোকপাত করে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন যুবক, যে নিজের সামাজিক অবস্থানকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে এবং একজন শিক্ষিত, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারীর প্রতি তার মনোভাব পরিবর্তিত হতে দেখা যায়।

অপরিচিতা গল্পের সংক্ষিপ্তসার

গল্পের প্রধান চরিত্র প্রথম পুরুষ বা বর্ণনাকারী, যার সাথে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিক্ষিত কন্যার বিবাহ ঠিক হয়। কিন্তু যখন সে জানতে পারে মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত এবং তার নিজস্ব চিন্তাভাবনা রয়েছে, তখন সে নিজেকে তার উপযুক্ত মনে করে না এবং বিয়ে বাতিল করে। পরে, সে বুঝতে পারে তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়।

অপরিচিতা গল্পের মূলভাব

গল্পটির মূল প্রতিপাদ্য হলো সমাজে প্রচলিত সংকীর্ণ চিন্তাধারার বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। এটি দেখায় কিভাবে নারীদের শিক্ষিত ও স্বাবলম্বী হওয়ার পথে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বাধা সৃষ্টি করে। গল্পের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ নারীর স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন।

অপরিচিতা গল্পের শিক্ষণীয় দিক

  1. নারীর শিক্ষার গুরুত্ব: গল্পটি বোঝায় যে শিক্ষিত নারী কেবল সংসার নয়, সমাজকেও এগিয়ে নিতে পারে।
  2. পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার সমস্যা: গল্পে দেখানো হয়েছে যে সমাজের কিছু প্রচলিত রীতিনীতি কিভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে প্রভাবিত করে।
  3. আত্মসম্মানবোধের গুরুত্ব: গল্পের নারী চরিত্রটি আত্মসম্মান বজায় রাখার মাধ্যমে তার শক্তিশালী মানসিকতার পরিচয় দেয়।
  4. সামাজিক পরিবর্তনের আহ্বান: রবীন্দ্রনাথ এখানে প্রচলিত সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য এক ধরনের বার্তা দিয়েছেন।
  5. সুন্দর সম্পর্কের জন্য সমঝোতা প্রয়োজন: শুধুমাত্র বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক স্থাপন করলে তা সফল হয় না।

অপরিচিতা গল্পের বিশ্লেষণ

“অপরিচিতা” গল্পটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্যান্য গল্পের মতো সমাজের গভীর মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলি তুলে ধরে।

  • নারী স্বাধীনতা: এখানে দেখানো হয়েছে কিভাবে শিক্ষিত নারীকে সমাজের কিছু মানুষ ভিন্নভাবে দেখে এবং তার স্বাধীনতাকে হুমকি হিসেবে দেখে।
  • পুরুষতন্ত্রের সংকীর্ণতা: গল্পের নায়ক নারীর স্বাধীন চিন্তাভাবনাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, যা সমাজের এক প্রচলিত সমস্যার প্রতিফলন।
  • পরিবর্তনের প্রয়োজন: গল্পের নায়ক পরে তার ভুল বুঝতে পারে, যা ইঙ্গিত করে যে সমাজের ধ্যানধারণা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

অপরিচিতা গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন এবং উত্তর

সৃজনশীল প্রশ্ন ১

সালমান রহমান একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র কন্যা নাদিয়ার সাথে তার বিয়ের দিন নির্ধারিত হলো। পাত্রপক্ষ ৫০ হাজার টাকা ও ২ ভরি স্বর্ণালংকার যৌতুক হিসেবে দাবি করল। এমন সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না ভেবে অসহায় পিতা বাধ্য হয়ে সম্মতি দিলেন।

প্রশ্ন:

ক. অনুপম হাতজোড় করার পর কার হৃদয় গলেছে?

খ. ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণী আর বিয়ে করবে না কেন?

গ. উদ্দীপকটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের মূল ভাবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ—ব্যাখ্যা কর।

ঘ. উদ্দীপকে ‘অপরিচিতা’ গল্পের ভাব পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে—তুমি কি একমত? তোমার মতামত যুক্তি-সহ ব্যাখ্যা কর।

সমাধান:

ক. অনুপম হাতজোড় করার পর কার হৃদয় গলেছে?

‘অপরিচিতা’ গল্পে অনুপম তার মায়ের কাছে কল্যাণীর সঙ্গে বিয়ে করার জন্য আকুল আবেদন করে। সে তার মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে কল্যাণী একজন আত্মনির্ভরশীল, শিক্ষিতা এবং আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন মেয়ে। অবশেষে অনুপম যখন হাতজোড় করে অনুরোধ জানায়, তখন তার মায়ের হৃদয় গলে যায় এবং তিনি বিয়েতে সম্মতি দেন। তবে এই সম্মতির পেছনে কল্যাণীর বাবার আর্থিক অবস্থা ও যৌতুক প্রদানের ক্ষমতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

খ. ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণী আর বিয়ে করবে না কেন?

‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণী আর বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় না কারণ সে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, শিক্ষিত ও স্বাধীনচেতা মেয়ে। গল্পে দেখা যায়, অনুপমের মা তার বাবার কাছ থেকে যৌতুক দাবি করেন, যা কল্যাণীকে ব্যথিত করে। কল্যাণী মনে করে, যেখানে একজন নারীকে অর্থ বা যৌতুকের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়, সেখানে সে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে পারবে না। সে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, “আমার বিবাহ হইবে না,” যা তার আত্মবিশ্বাস ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ। কল্যাণী বুঝতে পারে যে, সমাজে নারীদের মূল্যায়ন করা হয় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে, যা সে কখনোই মেনে নিতে পারে না। তাই সে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নিজের পথ নিজেই গড়ে নেওয়ার সংকল্প করে।

গ. উদ্দীপকটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের মূল ভাবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ—ব্যাখ্যা কর।

উদ্দীপকে মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়তার চিত্র এবং যৌতুকের নির্মম বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছে, যা ‘অপরিচিতা’ গল্পের মূল ভাবের সঙ্গে মিল রয়েছে।

গল্পে দেখা যায়, অনুপমের মা কল্যাণীর বাবার কাছে যৌতুক দাবি করেন এবং কল্যাণীর বাবাও অর্থনৈতিক চাপে পড়ে সম্মতি দেন। একইভাবে, উদ্দীপকে সালমান রহমানের পরিবার ৫০ হাজার টাকা ও ২ ভরি স্বর্ণালংকার যৌতুক হিসেবে দাবি করে, যা নাদিয়ার অসহায় বাবাকে বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়।

দুই ক্ষেত্রেই যৌতুকপ্রথার কারণে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে এবং সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদ স্পষ্ট হচ্ছে। কল্যাণী এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু উদ্দীপকে নাদিয়ার প্রতিক্রিয়া জানা যায় না।

তবে মূল বিষয়বস্তু একই—যৌতুক কেবল একটি অর্থনৈতিক লেনদেন নয়, এটি নারীর আত্মমর্যাদা ও সামাজিক অবস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে।

ঘ. উদ্দীপকে ‘অপরিচিতা’ গল্পের ভাব পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে—তুমি কি একমত? তোমার মতামত যুক্তি-সহ ব্যাখ্যা কর।

আমি আংশিক একমত। উদ্দীপকের ঘটনা এবং ‘অপরিচিতা’ গল্পের মধ্যে বেশ কিছু মিল থাকলেও মূল ভাব পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি।

প্রথমত, উভয় ক্ষেত্রে যৌতুকপ্রথার ফলে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার চিত্র দেখা যায়। ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণীর বাবা সামাজিক চাপে পড়ে অনুপমের মায়ের চাহিদা মেনে নিতে বাধ্য হন, একইভাবে নাদিয়ার বাবা সালমান রহমানের পরিবারের চাহিদা মেনে নেন।

তবে পার্থক্য হলো, কল্যাণী প্রতিবাদ করে এবং আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু উদ্দীপকে নাদিয়ার প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট নয়। সে কি প্রতিবাদ করেছে, নাকি সমাজের চাপে চুপচাপ মেনে নিয়েছে—এটি উল্লেখ নেই।

দ্বিতীয়ত, ‘অপরিচিতা’ গল্প নারীর আত্মসম্মান, শিক্ষার গুরুত্ব ও সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের বার্তা দেয়। কল্যাণী প্রমাণ করে যে একজন নারী শুধুমাত্র বিয়ের জন্য নয়, বরং নিজ যোগ্যতায়ও সম্মানিত হতে পারে। উদ্দীপকে এই দিকটি অনুপস্থিত, কারণ এখানে কেবল অসহায় বাবার দৃষ্টিকোণ দেখানো হয়েছে।

অতএব, যৌতুকপ্রথা ও সামাজিক বৈষম্যের বিষয়বস্তু উভয় ক্ষেত্রে থাকলেও, ‘অপরিচিতা’ গল্পের আত্মমর্যাদাবোধ ও নারীর প্রতিবাদী চেতনা উদ্দীপকে পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি। তাই আমি বলব, উদ্দীপকটি গল্পের মূল ভাবের সাথে আংশিক সাদৃশ্যপূর্ণ হলেও পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়নি।

সৃজনশীল প্রশ্ন ২

“দেখিলাম, এই সতের বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলো আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু এখনও শৈশবের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই।”

প্রশ্ন:

ক. কন্যাকে আশীর্বাদ করার জন্য কাকে পাঠানো হয়েছিল?

খ. স্যাকরাকে বিয়ে বাড়িতে কেন আনা হয়েছিল? ব্যাখ্যা কর।

গ. উদ্ধৃত অংশে বয়সের বিষয়টি ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযোজ্য? ব্যাখ্যা কর।

ঘ. ‘এখনও কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই’—এই বক্তব্যকে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর চরিত্রের আলোকে বিশ্লেষণ কর।

সমাধান:

ক. কন্যাকে আশীর্বাদ করার জন্য কাকে পাঠানো হয়েছিল?

‘অপরিচিতা’ গল্পে কন্যাকে আশীর্বাদ করার জন্য অনুপমকে পাঠানো হয়েছিল। অনুপম ছিল শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে, যার সঙ্গে কন্যার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। সে যখন বিয়ের কন্যাকে দেখতে যায়, তখনই সে মেয়েটির সৌন্দর্য ও সরলতা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ে এবং গল্পের এই উক্তিটি করে।

খ. স্যাকরাকে বিয়ে বাড়িতে কেন আনা হয়েছিল? ব্যাখ্যা কর।

স্যাকরা সাধারণত কুলীন ব্রাহ্মণ বা পুরোহিত শ্রেণির একজন সম্মানিত ব্যক্তি, যিনি বিয়ের মতো শুভ অনুষ্ঠানে আশীর্বাদ প্রদান ও ধর্মীয় বিধান সম্পন্ন করার জন্য আনা হয়।

‘অপরিচিতা’ গল্পে স্যাকরাকে আনা হয়েছিল সামাজিক রীতিনীতি অনুসারে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে এবং কন্যাকে আশীর্বাদ করার জন্য। এটি বাঙালি বিয়ের সংস্কৃতির একটি অংশ, যেখানে বয়োজ্যেষ্ঠ ও ধর্মীয় ব্যক্তিরা নবদম্পতির মঙ্গল কামনা করে আশীর্বাদ করে থাকেন।

গ. উদ্ধৃত অংশে বয়সের বিষয়টি ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর ক্ষেত্রে কতটুকু প্রযোজ্য? ব্যাখ্যা কর।

উদ্ধৃত অংশটি একটি ১৭ বছর বয়সী মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্য ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে প্রকাশ করছে। বলা হয়েছে যে, তার সৌন্দর্য পরিপূর্ণ হলেও মানসিকভাবে সে এখনো শৈশবের কোল থেকে বের হয়ে আসেনি।

‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর ক্ষেত্রেও এই বয়সের বিষয়টি কিছুটা প্রযোজ্য হলেও পুরোপুরি নয়। কল্যাণী এক তরুণী, যার বয়স আনুমানিক ১৭ থেকে ২০-এর মধ্যে হতে পারে। তবে সাধারণ ১৭ বছর বয়সী মেয়েদের মতো সে অপরিণত বা শিশুসুলভ নয়। বরং সে ছিল আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন, আত্মনির্ভরশীল এবং অত্যন্ত পরিপক্ব চিন্তাভাবনার অধিকারী।

তাই উদ্ধৃত অংশের মেয়েটি ও কল্যাণীর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। উদ্ধৃত অংশের মেয়েটি মানসিকভাবে শৈশব থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসেনি, কিন্তু কল্যাণী যথেষ্ট পরিণত ছিল এবং সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিতে সক্ষম হয়েছিল।

ঘ. ‘এখনও কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই’—এই বক্তব্যকে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর চরিত্রের আলোকে বিশ্লেষণ কর।

এই বক্তব্য বোঝায় যে মেয়েটি শারীরিকভাবে যুবতী হলেও মানসিকভাবে সে এখনো শৈশব বা কৈশোরের সরলতায় রয়েছে, জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়নি।

কিন্তু ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণী ছিল এই বিবরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে ছিল অত্যন্ত আত্মপ্রত্যয়ী ও বাস্তববাদী। সে সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে জানত।

যখন অনুপমের মা কল্যাণীর বাবার কাছ থেকে যৌতুক দাবি করেন, তখন কল্যাণী পরিস্থিতির গভীরতা বুঝতে পারে এবং দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে, “আমার বিবাহ হইবে না।” এটি প্রমাণ করে যে, সে কোনো শৈশবসুলভ দুর্বলতায় আটকে ছিল না; বরং নিজের সম্মানের জন্য লড়াই করার মতো পরিপক্বতা অর্জন করেছিল।

অতএব, উদ্ধৃত বক্তব্যের মেয়েটি যেখানে জীবন ও সমাজ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, কল্যাণী সেখানে সামাজিক বাস্তবতা ও নিজের অধিকারের প্রতি সম্পূর্ণ সচেতন। তাই এই বক্তব্য কল্যাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, বরং তার বিপরীত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

সৃজনশীল প্রশ্ন ৩

তুচ্ছ কারণে বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় সায়মা খাতুন আর বিয়ের পিঁড়িতে বসেননি। এখন তিনি সমাজসেবামূলক একটি সংস্থায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের লেখাপড়া শেখানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

প্রশ্ন:

ক. অনুপম হাত জোড় করে মাথা হেঁট করার পর কার হৃদয় গলেছে?

খ. কল্যাণী বিয়ে না করার পণ করেছে কেন?

গ. সায়মা খাতুনের সমাজসেবামূলক কাজ ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন দিককে নির্দেশ করে? ব্যাখ্যা কর।

ঘ. “সায়মা খাতুনের মানসিক দৃঢ়তা ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর ছায়ারূপ”—এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ কর।

সমাধান:

ক. অনুপম হাত জোড় করে মাথা হেঁট করার পর কার হৃদয় গলেছে?

‘অপরিচিতা’ গল্পে অনুপম যখন হাত জোড় করে মাথা হেঁট করে, তখন তার মায়ের হৃদয় গলে যায়। অনুপম চেয়েছিল কল্যাণীর সঙ্গে তার বিয়ে হোক, তাই সে তার মায়ের কাছে অনুরোধ জানায়। অবশেষে তার মা কল্যাণীর বাবার কাছ থেকে যৌতুক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং বিয়েতে সম্মতি দেন। তবে এটি নিছক ভালোবাসা থেকে নয়; বরং আর্থিক সুবিধার কারণেই তিনি মত পরিবর্তন করেন।

খ. কল্যাণী বিয়ে না করার পণ করেছে কেন?

কল্যাণী বিয়ে না করার পণ করেছে কারণ সে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল।

গল্পে দেখা যায়, অনুপমের মা যখন কল্যাণীর বাবার কাছে যৌতুক দাবি করেন, তখন কল্যাণী বুঝতে পারে যে সমাজে মেয়েদের মূল্যায়ন তাদের গুণাবলির ভিত্তিতে নয়, বরং টাকার পরিমাণ দিয়ে করা হয়। এটি তাকে ব্যথিত করে। সে বুঝতে পারে যে, যদি এই বৈষম্য মেনে নেয়, তবে তার আত্মসম্মান ক্ষুণ্ন হবে। তাই সে দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করে—“আমার বিবাহ হইবে না।”

এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কল্যাণী নারীর আত্মমর্যাদা ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং প্রমাণ করে যে বিয়ে ছাড়া একজন নারীও সমাজে সম্মান ও সফলতা অর্জন করতে পারে।

গ. সায়মা খাতুনের সমাজসেবামূলক কাজ ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন দিককে নির্দেশ করে? ব্যাখ্যা কর।

সায়মা খাতুনের সমাজসেবামূলক কাজ ‘অপরিচিতা’ গল্পের নারীর আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মমর্যাদাবোধের দিককে নির্দেশ করে।

গল্পে কল্যাণী কেবল বিয়ে না করার সিদ্ধান্তই নেয়নি, বরং সে নিজেকে যোগ্য ও স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলেছে। অনুপম পরে জানতে পারে যে কল্যাণী সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত এবং কেবল একজন গৃহবধূর ভূমিকা পালন করতেই জন্ম নেয়নি।

সায়মা খাতুনও একইরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি বিয়ে না করেও সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন, বিশেষ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য কাজ করছেন, যা নারীর আত্মনির্ভরশীলতারই প্রতিফলন। এতে বোঝা যায় যে নারীদের জীবনের সার্থকতা শুধু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়াতেই নয়; বরং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা এবং নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখাও গুরুত্বপূর্ণ।

ঘ. “সায়মা খাতুনের মানসিক দৃঢ়তা ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর ছায়ারূপ”—এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ কর।

বক্তব্যটি যথার্থ কারণ উভয় চরিত্রই সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজেদের আত্মমর্যাদা বজায় রেখেছেন।

১. সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান:
কল্যাণী যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে, সায়মা খাতুনও তুচ্ছ কারণে বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর আর বিয়ে করেননি, বরং সমাজসেবায় মনোনিবেশ করেছেন।

২. আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মসম্মান:
কল্যাণী অন্যের উপর নির্ভরশীল না থেকে নিজের পরিচয় গড়ে তুলতে চেয়েছে, যা পরে সে পেরেও দেখিয়েছে। সায়মা খাতুনও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের মাধ্যমে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন।

৩. নারীর বিকল্প সাফল্য:
গল্পে কল্যাণী প্রমাণ করেছে যে নারীর জন্য বিয়েই একমাত্র পথ নয়, বরং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাও গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে, সায়মা খাতুনও বিয়ে ছাড়া জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছেন এবং সমাজের জন্য কাজ করছেন।

 সায়মা খাতুন ও কল্যাণী উভয়ের মধ্যেই মানসিক দৃঢ়তা, আত্মসম্মানবোধ ও সমাজের অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার স্পষ্ট মিল রয়েছে। তাই বলা যায়, সায়মা খাতুনের মানসিকতা ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীরই ছায়ারূপ।

সৃজনশীল প্রশ্ন ৪

বিয়ে বাড়িতে যেন মহোৎসব শুরু হয়েছে। চারদিকে সাজসজ্জা আর আনন্দের উচ্ছ্বাস। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কন্যাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে বাবা-মা অঝোর নয়নে কাঁদতে লাগলেন।

প্রশ্ন:

ক. মামার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য কী ছিল?

খ. মামা বাড়ির স্যাকরাকে বিয়ে বাড়িতে কেন আনা হয়েছিল?

গ. উদ্দীপকের সাথে ‘অপরিচিতা’ গল্পের মিলগুলো নির্দেশ কর।

ঘ. উদ্দীপকটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের খণ্ডাংশ মাত্র—এই বক্তব্যের সত্যতা বিচার কর।

সমাধান:

ক. মামার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য কী ছিল?

‘অপরিচিতা’ গল্পে মামার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল তার ভাগ্নির (কল্যাণীর) বিয়ে দেওয়া।

গল্পে দেখা যায়, মামা ছিলেন কল্যাণীর অভিভাবকের মতো। তিনি চান, কল্যাণী যেন একটি ভালো পরিবারে বিয়ে হয় এবং তার ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত হয়। তবে কল্যাণীর বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা খুব ভালো না থাকায়, অনুপমের মায়ের যৌতুকের দাবি মেনে নিতে তারা বাধ্য হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, কল্যাণী নিজেই আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য বিয়ে ভেঙে দেয়।

খ. মামা বাড়ির স্যাকরাকে বিয়ে বাড়িতে কেন আনা হয়েছিল?

মামাবাড়ির স্যাকরা হলো বিয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথি, সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি, যিনি আশীর্বাদ প্রদান করেন এবং বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে সাহায্য করেন।

‘অপরিচিতা’ গল্পে স্যাকরাকে আনা হয়েছিল কন্যাকে আশীর্বাদ করার জন্য। এটি বাঙালি বিয়ের ঐতিহ্যের একটি অংশ, যেখানে পরিবারের প্রবীণ বা সম্মানিত ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন এবং নববধূকে আশীর্বাদ দেন।

গ. উদ্দীপকের সাথে ‘অপরিচিতা’ গল্পের মিলগুলো নির্দেশ কর।

উদ্দীপকের ঘটনাবলি ও ‘অপরিচিতা’ গল্পের মধ্যে কয়েকটি মিল রয়েছে—

  1. বিয়ে সংক্রান্ত আবেগ: 
    • উভয় ক্ষেত্রেই বিয়ের আনন্দমুখর পরিবেশ দেখা যায়।
    • তবে গল্পে আনন্দের মাঝেই যৌতুক প্রসঙ্গ উঠে আসে, যা কল্যাণীকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।
    • উদ্দীপকেও বিয়ের উচ্ছ্বাসের পরপরই কন্যার বিদায়ের মুহূর্তে বাবা-মার কান্নার চিত্র ফুটে উঠেছে।
  2. কন্যার বিদায়: 
    • গল্পে কল্যাণী নিজে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে বিয়ে করবে না, তাই তার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রশ্ন আসে না।
    • তবে উদ্দীপকে দেখা যায়, কন্যাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হচ্ছে এবং বাবা-মা কষ্ট পাচ্ছেন, যা বিয়ের আবেগপ্রবণ দিককে তুলে ধরে।
  3. পরিবারের অনুভূতি: 
    • ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণীর বাবা-মা বিয়ের আয়োজনে আনন্দিত ছিলেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কল্যাণীর সিদ্ধান্ত তাদের হতবাক করে।
    • উদ্দীপকেও দেখা যায়, বাবা-মা মেয়েকে বিদায় দিতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন।

ঘ. উদ্দীপকটি ‘অপরিচিতা’ গল্পের খণ্ডাংশ মাত্র—এই বক্তব্যের সত্যতা বিচার কর।

এই বক্তব্য আংশিক সত্য। কারণ উদ্দীপকের বিষয়বস্তু এবং ‘অপরিচিতা’ গল্পের পরিবেশের মধ্যে মিল থাকলেও, মূল ভাব পুরোপুরি একই নয়।

সাদৃশ্য:

  • দুটো ক্ষেত্রেই বিয়ের আয়োজন, সাজসজ্জা ও আবেগঘন মুহূর্তের চিত্র রয়েছে।
  • উভয় ক্ষেত্রেই কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা-মায়ের উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে।
  • বিয়ের মাধ্যমে সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুন এবং নারীর অবস্থান ফুটে উঠেছে।

পার্থক্য:

  • ‘অপরিচিতা’ গল্পে কল্যাণী বিদায়ের মুহূর্তেই বিয়ে ভেঙে দেয়, যেখানে উদ্দীপকে কন্যা শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে।
  • গল্পে মূলত যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, যেখানে উদ্দীপকে এটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই।
  • কল্যাণী বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নারীর আত্মসম্মানবোধের বার্তা দেয়, কিন্তু উদ্দীপকের কন্যার বিষয়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রতিবাদের চিত্র নেই।

উপসংহার:
উদ্দীপকের দৃশ্য ‘অপরিচিতা’ গল্পের আবেগঘন পরিবেশের একটি অংশের সঙ্গে মেলে, তবে এটি পুরো গল্পের প্রতিফলন নয়। তাই বলা যায়, উদ্দীপকটি গল্পের খণ্ডাংশের মতো হলেও মূল ভাবকে পুরোপুরি তুলে ধরে না।

অপরিচিতা গল্পের আধুনিক প্রেক্ষাপট

বর্তমান সমাজেও “অপরিচিতা” গল্পের প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান। এখনও অনেক পরিবারে নারীর উচ্চশিক্ষা বা স্বাধীন মত প্রকাশকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয় না। তাই এই গল্পটি নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার গুরুত্ব ও মানসিক পরিবর্তনের জন্য আজও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়।

শেষ কথা

“অপরিচিতা” গল্পটি কেবল একটি সাধারণ গল্প নয়; এটি সমাজের একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গল্প আমাদের শেখায় যে, সমাজ পরিবর্তনের জন্য মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। শিক্ষিত, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নারীর গুরুত্ব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা একান্ত জরুরি।

এই গল্পের সৃজনশীল প্রশ্ন এবং উত্তর যোগ করে শিক্ষার্থীরা আরো গভীরভাবে গল্পের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে পারবে।

Leave a Comment