চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন, যা মূলত সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মের সাধকদের রচিত গীতিকাব্য। এগুলো একধরনের আধ্যাত্মিক গান, যেখানে ধর্মীয় তত্ত্ব, দেহতত্ত্ব এবং সাধনপদ্ধতির সম্পর্কে সংকেতমূলক বর্ণনা করা হয়েছে। চর্যাগীতি রচনাকারীদের সিদ্ধাচার্য বলা হয়, কারণ তাঁরা ছিলেন উচ্চস্তরের সাধক, যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভের জন্য সহজিয়া বৌদ্ধ সাধনা করতেন।
চর্যাপদের আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যা পাওয়া গেছে, যেখানে মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম উল্লেখ রয়েছে। তারা সাধনা, দেহতত্ত্ব, সমাজচিত্র এবং আধ্যাত্মিক জ্ঞানের কথা তাদের পদগুলোর মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
চর্যাপদের রচয়িতা কারা ছিলেন
চর্যাপদের ২৪ জন সিদ্ধাচার্য ছিলেন মূলত বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক এবং গূঢ় তত্ত্ব বোঝানোর জন্য এই গানগুলো রচনা করেছিলেন। তাঁদের রচিত চর্যার মাধ্যমে বোঝা যায় যে, তাঁরা বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থান করতেন এবং তাঁদের সাধনার পদ্ধতিও ছিল বৈচিত্র্যময়।
চর্যাপদের ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের তালিকা:
1.লুইপা
2. কুক্কুরীপা
3. বিরুআ
4. গুণ্ডরীপা
5. চাটিলপা
6. ভুসুকুপা
7. কাহ্নপা
8. কাম্বলাম্বরপা
9. ডোম্বীপা
10. শান্তিপা
11. মহিত্তাপা
12. বীণাপা
13. সরহপা
14. শবরপা
15. আজদেবপা
16. ঢেণ্ঢণপা
17. দারিকপা
18. ভাদেপা
19. তাড়কপা
20. কঙ্কণপা
21. জঅনন্দিপা
22. ধামপা
23. তান্তীপা
24. লাড়ীডোম্বীপা
চর্যাপদের রচয়িতারা ছিলেন মূলত বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদ অনুসারী। তাঁরা সাধনা ও ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন, তবে তাঁদের ভাষা ছিল সংকেতময়, যা সন্ধ্যা ভাষা নামে পরিচিত।
সিদ্ধাচার্যের মূল বৈশিষ্ট্য:
তারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া শাখার সাধক ছিলেন। তাদের রচিত পদগুলো সংগীত আকারে পরিবেশিত হতো। তারা সংকেতমূলক ভাষায় সাধনার কথা বলেছেন। তাদের চর্যাগান সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়। তারা সাধনার মাধ্যমে আত্মার মুক্তির কথা বলেছেন।
চর্যাপদের কিছু রচয়িতার পরিচয়:
১. লুইপা
লুইপাকে চর্যাপদের অন্যতম প্রাচীনতম কবি হিসেবে ধরা হয়। তাঁর পদগুলোতে দেহতত্ত্ব ও সাধনার গূঢ় ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
২.কাহ্নপা
তিনি চর্যাপদের অন্যতম জনপ্রিয় কবি। সহজিয়া সাধনার মূলতত্ত্ব ও সংসারজীবনের মধ্যে মুক্তির উপায় তিনি তাঁর পদগুলোর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেছেন।
৩. ভুসুকুপা
ভুসুকুপা সমাজ ও ধর্মের সম্পর্ক নিয়ে গভীর তত্ত্ব আলোচনা করেছেন।
৪. শবরপা
তিনি শবর সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তাঁর পদে নিম্নবর্ণের মানুষের জীবনযাত্রা ও দার্শনিক চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে।
৫. ডোম্বীপা
তিনি চর্যাপদে নারী চরিত্রের ভূমিকা নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন এবং প্রেম, সাধনা ও ভক্তির সংযোগ দেখিয়েছেন।
চর্যাপদের রচয়িতাদের গুরুত্ব
চর্যাপদের সিদ্ধাচার্যরা শুধু কবি ছিলেন না, তাঁরা ধর্ম ও সমাজের দার্শনিকও ছিলেন। তাঁদের রচনায় সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মের ভাবধারা, সংসারের মায়া, মুক্তির পথ এবং মানবজীবনের গভীর রহস্য ফুটে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপ গঠনে অবদান রেখেছেন। সহজিয়া বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক সাধনাকে সহজ ও কাব্যময় ভাষায় প্রকাশ করেছেন। বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যিক রূপ তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন।
FAQ
চর্যাপদ কী?
উত্তর: চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম কাব্যগ্রন্থ। এটি সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকদের রচিত গানের সংকলন, যেখানে ধর্মীয় সাধনা, দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক বিষয়সমূহ সংকেতময় ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
চর্যাপদের রচয়িতারা কারা ছিলেন?
উত্তর: চর্যাপদের রচয়িতারা ছিলেন সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকগণ। তাঁরা মোট ২৪ জন ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে লুইপা, কাহ্নপা, ভুসুকুপা, শবরপা, ডোম্বীপা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
চর্যাপদ কোথায় পাওয়া যায়?
উত্তর: চর্যাপদের পুঁথি ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালা থেকে আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে তিনি এটি প্রকাশ করেন, যার নাম দেন “হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা”।
চর্যাপদের সাহিত্যিক গুরুত্ব কী?
উত্তর: চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় ও দার্শনিক গ্রন্থ নয়, বরং বাংলা গানের প্রথম রূপ, কীর্তনধর্মী সংগীতের পূর্বসূরি এবং সাহিত্যিক দিক থেকেও অনন্য। এছাড়া এটি বাংলা ভাষার প্রাচীনতম লিখিত রূপের নমুনা।
শেষ কথা,চর্যাপদের ২৪ জন সিদ্ধাচার্য বাংলা সাহিত্যের আদি কবি হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। তাঁদের লেখা পদগুলো শুধু ধর্মীয় তত্ত্ব নয়, বরং বাংলা ভাষার আদি রূপ, সংগীতধর্মী সাহিত্য এবং আধ্যাত্মিক ভাবধারার মূল্যবান নিদর্শন। তাঁদের রচিত চর্যা বাংলা সাহিত্যের আদি কীর্তন ও সংগীতের অন্যতম ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই চর্যাপদ এবং এর রচয়িতারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন।