চর্যাপদের মমার্থ লেখ

বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ।এটি এক ধরনের গীতিকাব্য, যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের সহজিয়া মতবাদের ভাবধারা প্রকাশ পেয়েছে। চর্যাগীতির ভাষা আপাতদৃষ্টিতে দুর্বোধ্য মনে হলেও এর গভীরে লুকিয়ে রয়েছে গভীর আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক অর্থ। চর্যাপদ সরল অর্থে ধর্মীয় ও দৈনন্দিন জীবনের চিত্র তুলে ধরলেও এর মধ্যে লুকিয়ে আছে দার্শনিক ব্যাখ্যা, যা সাধনা ও আত্মিক মুক্তির পথ দেখায়।

চর্যাপদের আবিষ্কার

চর্যাপদ বহু বছর ধরে নেপালের রাজদরবারের পুথিশালায় অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে ছিল। ১৯০৭ সালে প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সন্ধান করতে গিয়ে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই মূল্যবান চর্যাগীতিগুলো আবিষ্কার করেন। পরে তিনি ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে এটি প্রকাশ করেন এবং নাম দেন “হাজার বছরের পুরানো বাংলা ভাষার বৌদ্ধ গান ও দোহা”।

তবে পাণ্ডুলিপির মূল নাম ছিল “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”, যা পরে তিব্বতে পাওয়া সংস্কৃত টীকায় “আশ্চর্য চর্যাচয়” নামে উল্লেখিত হয়। ড. শহীদুল্লাহ তাঁর গবেষণায় “আশ্চর্য চর্যাচয়” নামটি ব্যবহার করলেও, অনেক গবেষক এর মতে মূল নাম হওয়া উচিত “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”।

চর্যাপদের সংকলক ছিলেন কানু ভট্ট এবং এর টীকাকার ছিলেন মুনিদত্ত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যে পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলেন, তাতে ৪৬টি সম্পূর্ণ এবং ১টি খণ্ডিত গীতি ছিল, অর্থাৎ মোট ৪৬.৫টি পদ। তাই ধারণা করা হয়, তাঁর পাওয়া পাণ্ডুলিপিটি খণ্ডিত ছিল।

পরবর্তীতে নেপাল থেকেই চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের সম্পূর্ণ সংস্করণ আবিষ্কৃত হয়। পরে ড. প্রবোধচন্দ্র বাগচী নেপাল থেকে চর্যাপদের একটি তিব্বতী অনুবাদ সংগ্রহ করেন, যেখানে ৫১টি সম্পূর্ণ পদ ছিল। ফলে ধারণা করা হয়, চর্যাপদের মোট পদসংখ্যা ছিল ৫১টি।

চর্যাপদের মমার্থ/ চর্যাপদের ভাবকথা

চর্যাপদ শুধুমাত্র কবিতা নয়, এগুলো গানের আকারে রচিত হয়েছিল। প্রতিটি পদে রাগের নাম উল্লেখ রয়েছে, যেমন—
রাগ পটমঞ্জরী

রাগ গউড়া
ধানসী রাগ
রাগ মল্লরী
রাগ শবরী

এগুলো বোঝায় যে চর্যাগীতি সুর, তাল ও লয়ের মাধ্যমে গাওয়া হতো। বর্তমানেও নেপালে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে চর্যাগান গাওয়া হয়, যা প্রমাণ করে যে এটি বাংলা কীর্তনের অন্যতম প্রাচীনতম নিদর্শন। বহু গবেষক একমত যে, চর্যাগানই বাংলা সংগীতের অন্যতম পুরোনো রূপ, যা কীর্তন গানের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

 

প্রশ্ন: চর্যাপদ কী?

চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ, যেখানে সহজিয়া বৌদ্ধ সাধকদের রচিত গীতিকাব্য সংকলিত হয়েছে। এটি মূলত ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারার প্রতিফলন।

প্রশ্ন: চর্যাপদ কে আবিষ্কার করেন?

১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের পুথিশালায় চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার করেন এবং ১৯১৬ সালে তা প্রকাশ করেন।

প্রশ্ন: চর্যাপদের মূল নাম কী ছিল?

চর্যাপদের মূল পাণ্ডুলিপির নাম ছিল “চর্যাচর্যবিনিশ্চয়”। পরে তিব্বতে পাওয়া সংস্করণে একে “আশ্চর্য চর্যাচয়” নামেও উল্লেখ করা হয়।

প্রশ্ন: চর্যাপদে মোট কতটি পদ আছে?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কৃত পাণ্ডুলিপিতে ৪৬.৫টি পদ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে তিব্বতী অনুবাদ থেকে জানা যায়, আসল সংখ্যা ছিল ৫১টি পদ।

প্রশ্ন: চর্যাপদ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

এটি বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন এবং বাংলা কীর্তনের অন্যতম প্রাচীন উৎস। চর্যাগীতি শুধুমাত্র সাহিত্য নয়, সংগীত হিসেবেও গাওয়া হতো এবং এটি সহজিয়া সাধনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

শেষ কথা,চর্যাপদ শুধু ধর্মীয় গান নয়, এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক শিক্ষা। এর মমার্থ বুঝতে হলে সাধনা ও সমাজ সম্পর্কে জানতে হয়। সহজ ভাষায় বললে, চর্যাপদ মানুষকে আত্মজ্ঞান অর্জন এবং সত্যের পথে চলার শিক্ষা দেয়।

Leave a Comment