কুম্ভ মেলা কি।কুম্ভ মেলা কে প্রবর্তন করেন।কুম্ভ মেলার ইতিহাস।কুম্ভ মেলা কোথায় অনুষ্ঠিত হয়

হিন্দুদের মহা উৎসব গুলোর মধ্যে একটি হল কুম্ভ মেলা। এটি মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় মেলা। যেখানে অনেক হিন্দু একত্রিত হয় আর উৎসব পালন করে। অনেকেই এই কুম্ভ মেলা এবং কুম্ভ মেলার ইতিহাস সম্পর্কে জানে‌ না। আর তাই আমরা আজ  এই আর্টিকেল এর মাধ্যমে কুম্ভ মেলা কি।কুম্ভ মেলা কে প্রবর্তন করেন।কুম্ভ মেলার ইতিহাস।কুম্ভ মেলা কোথায় অনুষ্ঠিত হয় তুলে ধরব। তাই কুম্ভ মেলা সম্পর্কে জানতে সম্পূর্ণ আর্টিকেল পড়ুন।

কুম্ভ মেলা কি

কুম্ভ মেলা মানেই বিশাল এক ধর্মীয় সমাবেশ! হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি শুধু একটা মেলা নয়, বরং এক বিশেষ তীর্থযাত্রা। প্রতি ৩, ৬, ১২ এবং ১৪৪ বছর অন্তর এই মেলা হয়। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশগুলোর একটি, যেখানে লাখ লাখ মানুষ একত্রিত হন।

হিন্দুরা বিশ্বাস করেন, এই মেলায় গিয়ে নদীতে স্নান করলে তাদের সব পাপ দূর হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এখানে বিশাল বড় ধর্মীয় আলোচনা, সাধু-সন্ন্যাসীদের সমাবেশ, সংস্কৃতি ও বাণিজ্যেরও মিলন ঘটে।

অনেকেই মনে করেন, ৮ম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য এই মেলার প্রচলন করেন। তবে, ঐতিহাসিকভাবে “কুম্ভ মেলা” নামে বড় কোনো উৎসবের উল্লেখ ১৯শ শতকের আগে পাওয়া যায়নি।

এই মেলার সময় সূর্য, চন্দ্র এবং বৃহস্পতির অবস্থানের উপর নির্ভর করে ঠিক করা হয়। প্রতি ১২ বছরে একবার চারটি স্থানে পালিত হয়। তবে প্রয়াগরাজ ও হরিদ্বারের মধ্যে ৬ বছরের ব্যবধান থাকে, যেখানে মহা কুম্ভ ও অর্ধ কুম্ভ মেলা হয়।

কুম্ভ মেলায় লক্ষ লক্ষ মানুষ অংশ নেন। ২০১৯ সালের প্রয়াগরাজ কুম্ভ মেলায় প্রায় ২০ কোটি মানুষ এসেছিলেন! এমনকি ৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র একদিনেই ৫ কোটির বেশি তীর্থযাত্রী গঙ্গায় স্নান করেছিলেন।

ইউনেস্কো একে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে বিশাল এক উৎসব!

কুম্ভ মেলার প্রকারভেদ

কুম্ভ মেলা তিন ধরনের হয়:

পূর্ণ কুম্ভ মেলা – প্রতি ১২ বছর পর একবার হয়। এই মেলাকে অনেকে শুধু কুম্ভ মেলা বা পূর্ণ কুম্ভ বলেও ডাকে।

অর্ধ কুম্ভ মেলা – এটা ৬ বছর পরপর প্রয়াগরাজ ও হরিদ্বারে হয়। পূর্ণ কুম্ভের মাঝখানে আয়োজিত হয় বলে একে অর্ধ কুম্ভ বলা হয়।

মহা কুম্ভ মেলা – এটা অনেক বিরল! প্রতি ১৪৪ বছর পর একবার হয়, অর্থাৎ ১২টি পূর্ণ কুম্ভের পরপর এটি অনুষ্ঠিত হয়।

২০১৯ সালে প্রয়াগরাজ কুম্ভ মেলায়, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ঘোষণা করেন যে অর্ধ কুম্ভ মেলাকে এখন থেকে “কুম্ভ মেলা” এবং পূর্ণ কুম্ভ মেলাকে “মহা কুম্ভ মেলা” বলা হবে।

কুম্ভ মেলা নামকরণ

কুম্ভ মেলা নিয়ে বললে, “কুম্ভ” শব্দটার মানে আসলে কলস বা ঘট, যেটা জল রাখার জন্য ব্যবহার হয়। পুরানো বৈদিক কাহিনিগুলোতে এই শব্দটা অনেক জায়গায় পাওয়া যায়, বিশেষ করে যেখানে অমৃত বা অমরত্বের রসের কথা বলা হয়েছে। যেমন, ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদসহ আরও অনেক সংস্কৃত শাস্ত্রে এই শব্দটা এসেছে। জ্যোতিষবিদ্যায়ও “কুম্ভ” একটা গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, কারণ এটা রাশিচক্রের কুম্ভ রাশির সাথেও জড়িত।

আর “মেলা” মানে একসাথে হওয়া, যোগ দেওয়া, বা মিলিত হওয়া। এই শব্দটাও অনেক পুরানো ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। সোজা কথায়, “কুম্ভ মেলা” বলতে বোঝায় এমন একটা উৎসব, যেখানে লোকজন এক জায়গায় জড়ো হয়।

কুম্ভ মেলা কে প্রবর্তন করেন

কুম্ভ মেলা হল হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে বড় তীর্থযাত্রা ও ধর্মীয় উৎসব, যা প্রতি ১২ বছরে একবার অনুষ্ঠিত হয়। এটি ভারতের চারটি স্থানে পালিত হয়—হরিদ্বার, প্রয়াগরাজ (পুরোনো নাম এলাহাবাদ), নাসিক ও উজ্জয়িনীতে।

কুম্ভ মেলার সূচনা প্রাচীন ভারতের পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের সাথে গভীরভাবে জড়িত। কথিত আছে, দেবতা ও অসুররা যখন সমুদ্রমন্থন করছিলেন, তখন অমৃতভর্তি কুম্ভ (কলস) থেকে কিছু অমৃত চারটি স্থানে পড়ে যায়। এই বিশ্বাস থেকেই এই চার স্থানে কুম্ভ মেলার প্রচলন হয়।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুযায়ী, কুম্ভ মেলার আনুষ্ঠানিক সূচনা করেছিলেন আদিগুরু শঙ্করাচার্য (৮ম-৯ম শতাব্দী)। তিনি এই মেলার গুরুত্ব প্রচার করেন এবং বিভিন্ন ধর্মগুরু ও সাধুদের একত্রিত করে এটি বৃহৎ আকারে আয়োজনের ব্যবস্থা করেন।

কুম্ভ মেলার ইতিহাস

দেবতা ও অসুররা যখন সমুদ্রমন্থন করছিলেন, দেবতা আর অসুররা মিলে অমৃত বের করেছিল। সেই অমৃত রাখা হয়েছিল একটা কলসে (যাকে কুম্ভ বলে)। তখন থেকেই অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন, কুম্ভ মেলার শুরু ওই সময় থেকেই, আর পুরাণেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু ইতিহাসবিদরা বলেন, এটা আসলে পরবর্তীতে গড়া একটা বিশ্বাস। কারণ পুরনো কোনো লেখায় “সমুদ্র মন্থন” আর “কুম্ভ মেলা” একসাথে পাওয়া যায় না। একদল পণ্ডিত মনে করেন, পুরনো কাহিনীগুলো সময়ের সঙ্গে বদলেছে এবং কিছু মানুষ এটাকে জনপ্রিয় তীর্থযাত্রার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে।

প্রয়াগ স্নানের নিয়মকানুন নিয়ে লেখা একটা পুরনো পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, যেটা ১৬৭৪ সালে লেখা হয়েছিল। এটা বলে দেয়, কীভাবে সেখানে গিয়ে স্নান করলে পূর্ণ্য পাওয়া যায়। বলা হয়, দেবতা আর অসুররা যখন অমৃতের পাত্র নিয়ে লড়াই করছিল, তখন সেটা চার জায়গায় পড়ে গিয়েছিল – প্রয়াগ, হরিদ্বার, উজ্জয়িনী আর নাসিকে। এটাই কুম্ভ মেলার মূল কারণ। কেউ বলেন, এই পাত্র বিষ্ণুর মোহিনী অবতার ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, কেউ বলেন ধন্বন্তরী বা গরুড় এটা করেছিল।

গল্প অনুসারে, একবার মহর্ষি দূর্বাসার অভিশাপে দেবতারা দুর্বল হয়ে পড়ে, আর তখন অসুররা আক্রমণ করে। তখন দেবতারা বিষ্ণুর কাছে গিয়ে সাহায্য চায়। বিষ্ণু বলেন, অসুরদের সঙ্গে মিলে সমুদ্র মন্থন করতে হবে, তাহলে অমৃত পাওয়া যাবে। তারা সেটাই করল, আর যখন অমৃত বের হলো, তখন ইন্দ্রের ছেলে জয়ন্ত সেটা নিয়ে আকাশে উড়ে গেল। কিন্তু অসুররা সেটা কেড়ে নিতে ধাওয়া করল। ১২ দিন ধরে দেবতা-অসুরদের লড়াই চলল, আর এই সময়েই কলস থেকে অমৃত চার জায়গায় পড়ে যায়।

তখন চন্দ্র, সূর্য, বৃহস্পতি আর শনিদেব অমৃত কলসকে রক্ষা করেছিল। পরে, বিষ্ণু মোহিনী রূপ নিয়ে সবাইকে অমৃত বিতরণ করেন, আর যুদ্ধ শেষ হয়। যেহেতু দেবতাদের ১২ দিন মানে মানুষের ১২ বছর, তাই ১২ বছর পরপর কুম্ভ মেলা হয়। যেসব জায়গায় অমৃত পড়েছিল, সেখানেই এই উৎসব হয়।

যদিও “কুম্ভ মেলা” শব্দটা পুরনো কোনো লেখায় নেই, তবুও বহু হিন্দু ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রয়াগে গঙ্গা, যমুনা আর পৌরাণিক সরস্বতী নদীর সংযোগস্থলে স্নান করা খুব পবিত্র। এজন্যই বহু মানুষ যুগ যুগ ধরে এখানে আসেন, আর এটাই কুম্ভ মেলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব তৈরি করেছে।

কুম্ভ মেলা কোথায় অনুষ্ঠিত হয়

এই মেলা চারটি পবিত্র স্থানে পালিত হয়—

  • প্রয়াগরাজ: যেখানে গঙ্গা, যমুনা ও সরস্বতী নদীর মিলন ঘটে।
  • হরিদ্বার: গঙ্গা নদীর তীরে।
  • নাসিক: গোদাবরী নদীর তীরে।
  • উজ্জয়িনী: শিপ্রা নদীর তীরে।

এছাড়াও, ২০২২ সালে দীর্ঘ ৭০০ বছর পর পশ্চিমবঙ্গের হুগলির বাঁশবেড়িয়াতেও কুম্ভ মেলা হয়েছে।

কোথায়, কখন, কোন নদীর তীরে হয় কুম্ভ মেলা?

স্থাননদীরাশিচক্র ও সময়কালপ্রথম স্নানের দিনদ্বিতীয়তৃতীয়
হরিদ্বারগঙ্গাবৃহস্পতি কুম্ভ রাশিতে, সূর্য মেষ রাশিতেশিবরাত্রিচৈত্র অমাবস্যামেষ সংক্রান্তি
প্রয়াগরাজগঙ্গা-যমুনা সঙ্গমবৃহস্পতি মেষ রাশিতে, সূর্য ও চন্দ্র মকর রাশিতেমকর সংক্রান্তিমাঘ অমাবস্যাবসন্ত পঞ্চমী
নাসিক (ত্র্যম্বক)গোদাবরীবৃহস্পতি সিংহ রাশিতেসিংহ সংক্রান্তিভাদ্র অমাবস্যাদেবোত্থান একাদশী
উজ্জয়িনীশিপ্রাবৃহস্পতি সিংহ রাশিতে, সূর্য মেষ রাশিতেচৈত্র পূর্ণিমাচৈত্র অমাবস্যাবৈশাখী পূর্ণিমা

 

কুম্ভ মেলা উৎসব ব্যবস্থাপনা

কুম্ভ মেলা একটি ঐতিহাসিক উৎসব, যেখানে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী একত্রিত হন। এই উৎসবের জন্য সঠিক ও নিরাপদ অস্থায়ী ব্যবস্থা তৈরি করা খুবই জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং। এখানে শিবির, খাবার, পানি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, জরুরি সেবা, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশিং, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা—সব কিছু ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে করতে হয়। তাছাড়া, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ এবং হারানো পরিবারের সদস্যদের সাহায্যের জন্য বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থা করা হয়।

২০১৩ সালে, ভারতীয় সরকার, সেবা স্বেচ্ছাসেবী, সন্ন্যাসী এবং স্থানীয় কোম্পানির সহযোগিতায়, ৫৫টি ক্যাম্প ক্লাস্টারসহ ১১টি সেক্টর স্থাপন করে। এই সেক্টরগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা, অ্যাম্বুলেন্স, ফার্মেসি, পানি, খাদ্য এবং অন্যান্য সেবা সরবরাহ করা হয়।

কুম্ভ মেলার মূল আকর্ষণ হল স্নান ও শোভাযাত্রা। তীর্থযাত্রীরা নদীতে স্নান করতে আসেন, যা তাদের পাপ মোচন এবং পুনর্জন্মের মুক্তির একটি উপায় হিসেবে দেখা হয়। শাহী স্নান বা রাজযোগী স্নান একটি বিশেষ অনুষ্ঠান, যেখানে সন্ন্যাসীরা শোভাযাত্রা করে নদীতে স্নান করতে যান। বিভিন্ন দেবতাদের পরিচিতি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হয়।

এছাড়াও, কুম্ভ মেলায় খাবারের আয়োজনও থাকে, যা অনেক তীর্থযাত্রী উপভোগ করেন। অনেক সময় তাঁরা উপবাস করেন এবং ও প্রার্থনায় অংশ নেন। উৎসবের পরিবেশ একেবারে নিরামিষাশী থাকে এবং বহু তীর্থযাত্রী দানশীলতা দেখিয়ে ভোজনের আয়োজন করেন। এই ভোজনের অংশ হিসেবে স্বেচ্ছাসেবীরা খাবার পরিবেশন করেন।

কুম্ভ মেলা শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি সাংস্কৃতিক নানা ধরনের অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে, যেমন কীর্তন, ধর্মীয় আলোচনা, সাংস্কৃতিক নৃত্য ও সঙ্গীত পরিবেশনা, এবং যোগ অনুশীলন।

এছাড়া, মেলার দর্শন এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে সাধুদের দর্শন নেওয়া হয় এবং উপাসকরা আধ্যাত্মিক পরামর্শ নেন।

উপসংহার

আশা করি আজকের এই আর্টিকেল আপনাদের কাজে এসেছে। কুম্ভ মেলা একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা। অনেকেই সারা বছর এই মেলার জন্য অপেক্ষায় থাকে। কুম্ভ মেলা কি।কুম্ভ মেলা কে প্রবর্তন করেন।কুম্ভ মেলার ইতিহাস।কুম্ভ মেলা কোথায় অনুষ্ঠিত হয় এই আর্টিকেলে আমরা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনাদের উপকারে এসেছে। সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

Leave a Comment